উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায় ‘অর্থনীতির বিভিন্ন দিক’ থেকে গুপ্তযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা উত্থানের পটভূমি আলোচনা কর।
গুপ্তযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা উত্থানের পটভূমি
প্রশ্ন:- গুপ্তযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে সামন্তপ্রথা উত্থানের পটভূমি ব্যাখ্যা করো।
ভূমিকা :- প্রাচীন ভারতে বিশেষত গুপ্তযুগে সামন্ততন্ত্রের উত্থান ঘটেছিল। বিশেষ কিছু ব্যবস্থা বা ঘটনা সামন্ততন্ত্রের উত্থানকে সহজ করেছিল। এক্ষেত্রে অগ্ৰহার প্রথা ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
অগ্ৰহার প্রথা
ভারতে গুপ্তযুগে সম্রাট এবং বিভিন্ন ধনীব্যক্তি পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ব্রাহ্মণদের নিষ্কর জমি দান করতেন। দান গ্রহিতা স্বয়ং প্রাপ্ত জমি বা গ্রামের রাজস্ব আদায়, আইন শৃঙ্খলা রক্ষা, প্রশাসন বা বিচার কার্য পরিচালনা প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ের অধিকারী হতেন। এটি অগ্রহার বা ব্রহ্মদেয় প্রথা নামে পরিচিত।
সামন্ততন্ত্রের বিকাশ
গুপ্তযুগে ভারতে সামন্ততন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করার জন্য অগ্রহার প্রথাকে ‘সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রদূত’ বলা হয়। অগ্রহার প্রথা যে সব উপায়ে সামন্ততন্ত্রের বিকাশে সহায়তা করেছিল সেই উপাদানগুলি হল।
(১) ভূমিদান
গুপ্তযুগে সম্রাট বা কোনো ধনী ব্যক্তির দ্বারা দান করা জমি জমির প্রাপকের হাতে হস্তান্তর হত। সাধারণত পুণ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে এই জমি দান করা হত। জমির সমস্ত মালিকানা সহ এমনকি জমির নীচে থাকা সম্পদের ওপরও গ্রহীতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হত। এই ভাবে কোনো ভূমির ওপর এক শ্রেণির মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে গুপ্তযুগে বিভিন্ন ভূস্বামীর আবির্ভাব ঘটে যা সামন্ততন্ত্রের ভিত্তি রচনা করে।
বাণিজ্যের অবনতি
সামন্ততন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কৃষি-অর্থনীতির ওপর বেশি নির্ভরতা এবং বাণিজ্যের অবনতি।ড. রামশরণ শর্মা ও ড. যাদব দেখিয়েছেন যে, গুপ্তযুগে অগ্রহার ব্যবস্থার বিকাশের ফলে স্বনির্ভর গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিই মুখ্য হয়ে ওঠে। রােমান সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের সঙ্গে রােমের সক্রিয় বাণিজ্যিক সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। ফলে ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নগরের অবক্ষয়
অগ্রহার প্রথাকে ভিত্তি করে গুপ্তযুগে উদ্ভূত নতুন ভূস্বামীরা কৃষি উৎপাদনে শ্রমের ওপর জোর দিলে শিল্প ও বাণিজ্য অবহেলিত হয়। ফলে নগরগুলির অবক্ষয় শুরু হয়। এই সময় প্রাচীন নগরজীবনের অবক্ষয় এবং গ্রামজীবনের প্রসার সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(২) ব্যক্তিগত মালিকানা
ইতিহাসবিদ ড. রামশরণ শর্মা মনে করেন গুপ্তযুগে ভারতে গোষ্ঠী মালিকানা সংকুচিত হয়ে ব্যক্তিগত মালিকানায় পরিণত হয়। এছাড়া তিনি মনে করেন ব্যক্তিগত মালিকানার প্রসারে অন্যতম উদ্যোগ নিয়েছিল অগ্রহার ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে রাজা বা কোনো ধনী ব্যক্তির দ্বারা জমি ব্রাহ্মণ বা কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দান করা হত। এর ফলে ওই জমির উপর দাতার অধিকার খর্ব হয়ে গ্রহীতার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হত।
(৩) ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থা
গুপ্ত যুগের বিভিন্ন স্মৃতি শাস্ত্রগুলি থেকে জানা যায় যে, সে যুগে ভূমিদানের ফলে ভূমি -ব্যবস্থার তিনটি স্তরের সৃষ্টি হয়েছিল। যথা – মহিপতি অর্থাৎ রাজা, স্বামী অর্থাৎ জমির প্রাপক এবং কৃষক অর্থাৎ শোষিত শ্রেণি। এদের অবস্থানের ক্রম হল রাজা-ভূস্বামী- অগণিত শোষিত কৃষক।এইভাবে গুপ্তযুগে ভারতে সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোটি গড়ে ওঠে।
সমালোচনা
সামন্ততান্ত্রিক বিকাশে সহায়ক উপাদানের কথা বিভিন্ন ঐতিহাসিক উল্লেখ করলেও কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক এর সর্বোচ্চস্তরীয় সমালোচনাও করেছিল। যেমন –
(১) রণবীর চক্রবর্তীর মত
ঐতিহাসিক ড. রণবীর চক্রবর্তীবলেনমে, গুপ্তযুগে রাজ অনুশাসনগুলিতে দান গ্রহীতাকে রাজ বিরোধী কাজ থেকে দূরে থাকার কঠোর নির্দেশ দেওয়া, এমনকি জমি কেড়ে নেওয়ার পর্যন্ত হুমকি দেওয়া হয়েছে।
(২) ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়ের মত
অধ্যাপক ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে, আদি মধ্যযুগে ভারতে তৃতীয় পর্বের নগরায়ণ প্রক্রিয়া চলেছিল। এছাড়াও ড. দীনেশচন্দ্র সরকার, হরবংশ মুখিয়া প্রমুখ ইতিহাসবিদগণ সামন্ততান্ত্রিক বিকাশের তীব্র সমালোচনা করেছেন।
উপসংহার :- গুপ্তযুগে ভারতে সামন্ততন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিতর্কের কোনো সুস্পষ্ট মীমাংসা এখনো হয়নি। ইতিহাসবিদ ডক্টর এ এল বাসাম গুপ্ত যুগের ভারতীয় আর্থসামাজিক অবস্থাকে আধা সামন্ততান্ত্রিক বা সামন্ততান্ত্রিক ধাঁচের বলে অভিহিত করেছেন।