উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস পঞ্চম অধ্যায় ‘অর্থনীতির বিভিন্ন দিক’ থেকে মধ্যযুগের ইউরোপে বাণিজ্যের বিকাশের প্রধান কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
মধ্যযুগের ইউরোপে বাণিজ্যের বিকাশের প্রধান কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা
প্রশ্ন:- মধ্যযুগের ইউরোপে বাণিজ্যের বিকাশের প্রধান কারণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করো।
ভূমিকা :- মধ্যযুগের (৪৭৬-১৪৫৩ খ্রিঃ) প্রথম দিকে ইউরোপে বেশ কিছুকাল রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অস্থিরতা বিরাজ করায় তখন বাণিজ্যের বিশেষ অগ্রগতি ঘটেনি। কিন্তু কিছুকাল পর ইউরোপীয় সমাজ ও রাজনীতিতে শান্তি ও স্থিরতা ফিরে এলে বাণিজ্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। এই সময় ইউরোপে বাণিজ্যের বিকাশের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –
(১) কুসেডের ভূমিকা
প্রায় দুশো বছর (১০৯৬-১২৯১ খ্রিঃ) পর্যন্ত চলা ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্যের সামগ্রীর চাহিদা পাশ্চাত্যে বৃদ্ধি পায়।এর ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ব্যাপক বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা স্থাপিত হয়। এই যোগাযোগের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর আমদানি ও রপ্তানি আরম্ভ হয়।
(২) নগর জীবনের প্রসার
একাদশ শতকের পরবর্তীতে ইউরোপের পুরোনো শহরগুলির পুনরুত্থান প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং বেশ কিছু নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে উদ্বৃত্ত ফসলের জোগান নগরের বিকাশে সহায়তা করে। নেপলস, পিসা প্রভৃতি প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির পাশাপাশি ভেনিস, মিলান, জেনোয়া প্রভৃতি নতুন নতুন নগরগুলি বিভিন্ন দেশের বণিকদের বাসস্থান ও পণ্য চলাচলের কেন্দ্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নগরগুলিতে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন এবং তা বিক্রির জন্য বাজার গড়ে উঠলে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। সামন্তপ্রভুদের পরিবর্তে নগরগুলিতে ব্যবসায়ী ও শিল্প কারখানার মালিকরা বেশি মর্যাদার অধিকারী হয়।
(৩) গিল্ডের প্রতিষ্ঠা
বণিক সংঘ সাধারণত গিল্ড নামে পরিচিত হয়। এই সমস্ত বণিক সংগঠনগুলি কাঁচামালের জোগান অব্যাহত রাখা, বাণিজ্যিক পণ্য উৎপাদন সচল রাখা এমনকি নিজেদের প্রয়োজনে আইন রচনা করা প্রভৃতি কার্য সম্পাদন করত। কতকগুলি গিল্ড যুক্ত হয়ে এক একটি লিগ (Leauge) গঠন করত। লিগগুলি সাধারণত বড়োমাপের বৈদেশিক আমদানি রপ্তানিতে যুক্ত থাকত।
(৪) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি
ইউরোপে শান্তি স্থাপনের পরবর্তীকালে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে বণিকরা জলপথ ও স্থলপথে বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি দিতে আরম্ভ করে। রাজকীয় বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে বণিকদের নিজস্ব রক্ষী বাহিনী কাজ শুরু করলে দস্যুদের হাত থেকে বণিক ও পণ্য উভয়েই রক্ষা পায় অর্থাৎ পণ্য ও বণিকদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পায়।
(৫) মূল্যবৃদ্ধি
দ্বাদশ থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত ইউরোপে জিনিসপত্রের দাম যথেষ্ট হারে বৃদ্ধি পায় যা সাধারণত মূল্যবৃদ্ধি নামে পরিচিত। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে বণিকদের হাতে প্রচুর মূলধন কেন্দ্রীভূত হয় যা বাণিজ্যের বিকাশে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছিল।
(৬) লোম্বার্ডদের আক্রমণ
বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ভূমধ্যসাগরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ক্রমাগত লোম্বার্ডদের আক্রমণের ফলে সেখানকার কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হয়।ফলে এখানকার মানুষ কুটির শিল্প ও বাণিজ্যকে জীবিকা হিসাবে বেছে নেয়। তারা শীঘ্রই পণ্য দ্রব্যের বিশাল বাজারে অংশ গ্রহণ করে এবং ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি ঘটিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনতে সক্ষম হয়।
(৭) কম্পাসের আবিষ্কার
দ্বাদশ শতকে কম্পাসের আবিষ্কারের ফলে অজানা সমুদ্রে নির্ভয়ে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হলে জলপথে পণ্য আদান প্রদানে বিশেষ সুবিধা হয়। এর ফলে নতুন নতুন বাণিজ্য পথ ও বাজারের সন্ধান মেলায় বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়।
(৮) বাণিজ্য মেলা
ইউরোপের বড়ো বড়ো শহরগুলিতে বছরে অন্তত একবার বাণিজ্য মেলা বসত। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মানুষ এইসব মেলায় পণ্য ক্রয় বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে আসত। পাইকারি বণিকরা মেলা থেকে পণ্য কিনে দূরদূরান্তে রপ্তানি করত। এভাবেও বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছিল।
উপসংহার :- ইউরোপের বাণিজ্যিক অগ্রগতিতে আরবের মুসলিমদেরও পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। মুসলিম ব্যবসায়ীরা ইতালির বিভিন্ন বাণিজ্য কেন্দ্রের সঙ্গে লেনদেন শুরু করেছিল। এর ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পণ্য আদান-প্রদান সহজ হয়।