উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস তৃতীয় অধ্যায় ‘রাজনৈতিক বিবর্তন: শাসনকার্য ও প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ধারণা’ থেকে এথেন্সে গণতন্ত্রের ভিত্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও গ্রীক পলিসগুলির প্রতিষ্ঠার পটভূমি কি ছিল তা আলোচনা কর।
এথেন্সে গণতন্ত্রের ভিত্তি ও গ্রীক পলিসগুলির প্রতিষ্ঠার পটভূমি আলোচনা
প্রশ্ন:- এথেন্সে গণতন্ত্রের ভিত্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়? গ্রীক পলিসগুলির প্রতিষ্ঠার পটভূমি কি ছিল? (8+8)=৮
ভূমিকা :- গ্রীসের নগররাষ্ট্রগুলির মধ্যে এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিতছিল। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্কারের মধ্যে দিয়ে এথেন্সেগণতন্ত্রের ভিত্তি রচিত হয়েছিল। এছাড়াও বিশেষ কিছুপদ্ধতি এথেন্সের গণতন্ত্রের ভিতরচনাকরে।
সোলনের সংস্কার
গণতান্ত্রিক এথেন্সের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন সোলন। তিনিই প্রথম বংশ কৌলিন্যের বদলে সম্পদের ভিত্তিতে এথেন্সের নাগরিকদের চারটি গোষ্ঠীতে ভাগ করেন।যথা –
- (i) পেন্টিকোসিও মেডিমনয়,
- (ii) হিঞ্জি বা নাইট,
- (iii) জিউপিটাই এবং
- (iv) থেটিস।
এছাড়া তিনি হেলাইয়া নামে এক গণ আদলত গড়ে তোলেন, যেখানে সাধারণ মানুষ আর্কনদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকারী ছিলেন।
ক্লিসথিনিসের সংস্কার
ক্লিসথিনিস গোষ্ঠীভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তে গ্রাম ভিত্তিক ১০টি অঞ্চল গড়ে তোলেন। সেগুলিই হয়ে ওঠে স্থানীয় শাসনব্যবস্থার এক একটি একক।
এফিয়ালটিসের সংস্কার
এফিয়ালটিস আইন করে অ্যারিওপেগাস কাউন্সিলের সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তা গণপরিষদ, কাউন্সিল ও গণআদালতের মধ্যে ভাগ করে দেন।
পেরিক্লিসের সংস্কার
পেরিক্লিস লটারির মাধ্যমে সমস্তনাগরিককে শাসনকার্যে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন। এছাড়া আর্কন পদের অধিকারীকে রাষ্ট্রের বেতনভুক কর্মীতে পরিণত করেন। তিনি নাগরিকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে এথেনীয় পিতামাতার সন্তানদেরই নাগরিক হওয়ার অধিকার দান করেন।
লটারির মাধ্যমে নির্বাচন
সাধারণ শ্রেণীর প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য এথেন্সে লটারির মাধ্যমে জনসাধারণের মধ্যে থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য শাসনকর্তাদের নির্বাচিত করা হত। তবে এক্ষেত্রে এক ব্যক্তি একাধিকবার নির্বাচিত হতে পারত না।
গণবিতর্ক
এথেন্সের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে একলেসিয়ার অধিবেশনে বিতর্ক হত। কোনো একটি প্রস্তাব উঠলে তার পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্কের পর উপস্থিত নাগরিকদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের দ্বারা তা নির্বাচিত হত।
জনগণের শাসন
গ্রীক শব্দ ‘ডেমস ও ‘ক্যাটাসে থেকেই ইংরেজি ‘ডেমোক্রেসি শব্দটি এসেছে। ডেমস হল কোনো একটি পলিসের সমস্ত নাগরিক সংখ্যা এবং ক্র্যাটাস হল শাসক। এই বিচারে এথেনীয় গণতন্ত্র ছিল জনগণের শাসন। এই শাসনব্যবস্থায় দরিদ্র জনগণের একটা বড়ো অংশ যুক্ত হওয়ার ফলে গণতন্ত্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলবলা চলে। তাই সাইমন হর্ন ব্লোয়ার লিখেছেন, “এথেনীয় গণতন্ত্র আধুনিক ব্রিটেন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বেশি গণতান্ত্রিক ছিল’।
পলিস
গ্রিক শব্দ ‘পলিস’-এর অর্থ নগররাষ্ট্র বা City state’ এগুলিকে ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও বলা যায়। মূলত স্বল্প আয়তনযুক্ত, কম জনসংখ্যাবিশিষ্ট ঐক্যবদ্ধ, স্বশাসিত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে গ্রিসের ইতিহাসে পলিস বলে।
পলিস বানগররাষ্ট্রের উদ্ভবের কারণসমূহ
বিভিন্ন কারণে প্রাচীন গ্ৰীসে পলিস বা নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল।যেমন –
(১) ভৌগোলিক পরিবেশ
অনেক ঐতিহাসিক পলিসগুলির উদ্ভবের জন্য ভৌগোলিক অবস্থানকেই অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। তাঁদের মতে, পাহাড়, পর্বত ও সমুদ্র দ্বারা বেষ্টিত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভূখণ্ড স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্বত্তা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
(২) শক্তিশালী শাসকের অনুপস্থিতি
ডোরিয়ান বিজয়ের পরবর্তীকালে গ্রিসে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তারই অন্যতম ফসল ছিল পলিসগুলির উদ্ভব। কোনো শক্তিশালী শাসক না থাকায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এককে জনপদগুলি বিভক্ত হয়ে পড়ে।
(৩) গ্রীসবাসীর মানসিকতা
গ্রিসের অধিবাসীরা পার্শ্ববর্তী বৃহৎ পারস্য দেশকে অপছন্দ করতেন। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, আয়তনের রাষ্ট্রে বসবাস করতে তাঁরা অনেক বেশি পছন্দ করতেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এই রাষ্ট্রকে ‘A perfect community’ বলে উল্লেখ করেছেন।
(৪) অর্থনৈতিক কারণ
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অ্যাক্রোপলিসের মতো বাজার সৃষ্টি, উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি প্রভৃতিও হতে লাগল। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব বাজার অর্থনীতি গড়ে উঠল, যা পরবর্তীতে নগররাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
(৫) সামাজিক প্রভাব
গ্রিসবাসী নিজেদের একাত্মতায় বিশ্বাসী যেমন ছিল তেমনি ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও তারা যোগ দিতে পছন্দ করত। তারা দূরবর্তী স্থানে বাজার ও ফাঁকা স্থানে একসঙ্গে মিলিত হতে পছন্দ করত। পরবর্তীকালে এই বাজারগুলিই আলাদা আলাদা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তৈরি করেছিল।
(৬) সামরিক কারণ
ডোরীয় আক্রমণে বিধ্বস্ত গ্ৰীসবাসি স্থানীয় সুরক্ষিত সামরিক কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে থাকে। যা থেকে পাহাড়ের উঁচু সংরক্ষিত স্থানগুলিতে তারা দুর্গ গড়ে তোলে। যেগুলি পরবর্তীতে জনগণের মিলনকেন্দ্র, ধর্মীয় কেন্দ্র তথা শক্তিশালী কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।
উপসংহার :- প্রাচীনকালে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্ৰিক পলিস গুলি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে গ্ৰিকদের মনোভাব বা মানসিকতা বিশেষ ভাবে কাজ করেছিল।এথেন্স ছিল প্রাচীন গ্ৰিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পলিস বা নগররাষ্ট্র, যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল।