উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সমাজের ঘটনা প্রবাহ’ থেকে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থানের ওপর আলোকপাত করা হল।
প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থানের ওপর আলোকপাত করো
প্রশ্ন:- প্রাচীন ভারতীয় সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থানের ওপর আলোকপাত করো।
ভূমিকা:- প্রাচীন যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান নানা সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে। পুরান, রামায়ণ, মহাভারত, মনুস্মৃতি, যাজ্ঞবল্কস্মৃতি, মেগাস্থিনিসের ইণ্ডিকা, বানভট্টের হর্ষচরিত প্রভৃতি প্রাচীন সাহিত্যেও নারীর সামাজিক অবস্থানের পরিচয় পাওয়া যায়।
ঋগবৈদিক সমাজে নারী
ঋক বৈদিক যুগে পরিবারের অধিকাংশ সদস্য পুত্র সন্তান কামনা করলেও নারীরা মোটেই অবহেলিত ছিল না। এই সময় নারীরবিশেষ গুরুত্ব ছিল। যেমন –
(১) পুরুষের ওপর নির্ভরশীলতা
ঋগবৈদিক সমাজে নারীরা বিবাহের পূর্বে বাবা বা ভাই এবং বিবাহের পরস্বামী বা ছেলের তত্ত্বাবধানে জীবন কাটাত।
(২) বিবাহ রীতি
এই সময় মেয়েরা পতি নির্বাচনে স্বাধীনতা ভোগ করত। বহুবিবাহের প্রচলন না থাকলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের একাধিক স্ত্রীর উল্লেখ পাওয়া যায়। অভিজাত পরিবারের বাইরে সতীদাহ প্রথার চল ছিল না, বিধবা বিবাহেরও প্রচলন ছিল না, তবে স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান স্ত্রী দেওরকে বিয়ে করতে পারতেন।
(৩) গৃহস্থালি পরিচালনায় নারী
ঋগবৈদিক সমাজে গৃহস্থালির ব্যপারে স্ত্রী ছিলেন সর্বময় কর্ত্রী। বৃহৎসংহিতায় উল্লেখ আছে যে, নারী হল গৃহলক্ষ্মী। পরবর্তী সময়ে বাৎসায়নের কামসূত্রে বলা হয়েছে যে, গৃহবধূরূপে নারীকে বাড়ীর সব কাজ করতে হত।
(৪) গৃহের বাইরে নারী
সেই যুগে সামাজিক উৎস অনুষ্ঠানে অবাধে যোগ দেওয়ার এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণের অধিকারও তাদের ছিল। ধর্মীয় কাজে স্ত্রীরা স্বামীকে সাহায্য করত। তাই তাঁদের বলা হত সহধর্মিণী। সে যুগে জুহু, পৌলমী ও কামায়নীর মতো মেয়েরা ধর্মীয় সাধনাতে সাফল্য দেখিয়েছিলেন।
(৫) শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা
ঋগবৈদিক যুগে শিক্ষাক্ষেত্রেও মেয়েদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল।ঘোষা, অপালা প্রমুখ মহিলারা বিভিন্ন শাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান ছিল।
পরবর্তী বৈদিক সমাজে নারী
পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা পূর্বের তুলনায় হ্রাস পায়। তবে এই সময় নারীরা একেবারেই গুরুত্বহীন ছিল না।যেমন –
(১) শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকা
এই সময় নারীদের কাছে শিক্ষার অধিকার কিছুটা সংকুচিত হলেও সম্পূর্ণ রূপে রূদ্ধ হয়ে যায়নি, বহু নারী দর্শন ও ধর্মচর্চায় জীবন অতিবাহিত করেছেন।
(২) বিবাহরীতির পরিবর্তনে নারীর অধিকার লোপ
পরবর্তী বৈদিক যুগে বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহুবিবাহ, পণপ্রথা প্রভৃতি নারীজীবনকে দুর্বিসহ করে তোলে, রাজপরিবারে বহুবিবাহের ফলে মহিষী বা প্রধান রানি ছাড়া বাকি রানিরা ছিলেন অবহেলা ও অনাদরের পাত্রী।
(৩) নারীর রাজনৈতিক তথা ধর্মীয় অধিকার সংকোচন
পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীর রাজনৈতিক অধিকার খর্ব করা হয়। পরবর্তী বৈদিক যুগে ধর্মীয় কাজের দায়িত্ব পুরোহিত শ্রেণির হাতে চলে যায়।
মৌর্য যুগে নারী
মৌর্যযুগে নারীরাবিভিন্ন ক্ষেত্রে যথেষ্ট সুযোগ পেতেন।এই সময় নারীরমর্যাদা বৃদ্ধি পায়। যেমন –
(১) শিক্ষা সংস্কৃতি
মৌর্য যুগে অভিজাত বংশীয় নারীরা লেখাপড়া শিখত।এই সময় নারীরা সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করতে পারত। মেগাস্থিনিস তার ইণ্ডিকা গ্রন্থে চন্দ্রগুপ্তের নারী রক্ষী বাহিনীর উল্লেখ করেছেন।
(২) সম্পত্তির অধিকার
মৌর্য যুগে নারীরা সম্পত্তির অধিকার পেত, অর্থশাস্ত্রে দুধরনের স্ত্রীধনের কথা বলা হয়েছে।
(৩) গার্হস্থ্য জীবন
গৃহে নারীরা বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ করতেন। গৃহে অতিথি আসলে তার সেবা করা ছিলনারীর প্রধান কর্তব্য।
মৌর্য পরবর্তী যুগে নারী
মৌর্য পরবর্তী যুগের নারীর মর্যাদা অক্ষুন্ন ছিল। এই সময়েও নারীরা বিশেষখ্যাতি লাভ করেন।যেমন –
(১) শিক্ষা সংস্কৃতি
মৌর্য পরবর্তী যুগে অনেক মহিলাউচ্চশিক্ষা লাভ করতেন। পাণিনি বলেছেন যে, এই সময় নারীরা বেদ অধ্যায়ন করতেন। জৈনশাস্ত্র থেকেজানা যায় যে, কৌশাম্বীর রাজকন্যা জয়ন্তী আজীবন অবিবাহিত থেকে বিদ্যাচর্চা করেছিলেন।
(২) বিবাহরীতি
মৌর্য পরবর্তী যুগের সমাজে বিবাহরীতি নিয়ে পরস্পরবিরোধী মতভেদ বর্তমান।মনুস্মৃতিতে নির্দেশ আছে যে, নারী প্রথম জীবনে পিতার, বিবাহের পর স্বামীর ও পরবর্তী জীবনে পুত্রের অধীনে বার্ধক্য জীবন কাটাবে। মৌর্যোত্তর সমাজে অনুলোম ও প্রতিলোম এই দুই বিবাহরীতির প্রচলন ছিল।
(৩) গার্হস্থ্য জীবন
মৌর্য পরবর্তী সময়ে নারীদের স্বামীর গৃহে মিলেমিশে থাকতে হত এবং গৃহের কাজ করতে হত।
গুপ্তযুগে নারী
গুপ্ত যুগে নারীদের সামাজিক মর্যাদা বহুলাংশের হ্রাস পায়।তবে এই সময় নারী শিক্ষার বিষয়টিঅব্যাহত ছিল।
(১) ধর্মীয় অধিকার
গুপ্ত যুগে কেবল স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে স্ত্রী বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারত।
(২) বিবাহরীতি
গুপ্ত যুগে মেয়েদের স্ববর্ণে বিবাহেরপাশাপাশি পতি নির্বাচনের অধিকার ছিল। বিধবাবিবাহেরচল থাকলেও সতীদাহ প্রথার চল ছিল না।
(৩) সম্পত্তির অধিকার
মনুস্মৃতি এবং মহাকাব্য দুটিতে নারীর সম্পত্তির অধিকার স্বীকার করা হলেও সামগ্রিকভাবে এই যুগে নারীর সামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছিল।
(৪) দেবদাসী প্রথা
এই যুগে সমাজে দেবদাসীদের সংখ্যাখুব বৃদ্ধি পায়।
(৫) শিক্ষাগত সংস্কৃতি
গুপ্তযুগে সম্ভ্রান্ত মহিলাদের উচ্চ শিক্ষালাভের সুযোগ ছিল। অমরকোশ গ্রন্থে শিক্ষিকাদের উপাধ্যায়া ও আচার্যা বলা হয়েছে।
উপসংহার :- প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগের সমাজে নারীর মর্যাদার হ্রাসবৃদ্ধি সত্বেও ভারতের নারীরা শিক্ষা গ্রহণে যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষরও রেখেছিলেন।