বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য কী? বর্ণ ও জাতির ধারণা মধ্যে পার্থক্য লেখ

উচ্চ মাধ্যমিক একাদশ শ্রেণীর ইতিহাস ষষ্ঠ অধ্যায় ‘সমাজের ঘটনা প্রবাহ’ থেকে বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য কী ? বর্ণ ও জাতির ধারণা মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর।

বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য কী? বর্ণ ও জাতির ধারণা মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন:- বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য কী ? বর্ণ ও জাতির ধারণা মধ্যে পার্থক্য লেখ।

ভূমিকা :- ভারতে বর্ণ প্রথার উদ্ভব ঠিক কবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ রয়েছে। তবে মনে করা হয় ভারতবর্ষে আর্যরা আসার আগে থেকেই বর্ণ প্রথার অস্তিত্ব ছিল।

বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য

ভারতে ঋগবৈদিক যুগে আর্য সমাজে বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল। এই বর্ণপ্রথার বৈশিষ্ট্য গুলি হল নিম্নরূপ –

(১) উদ্ভব

অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন যে, ভারতে আগমনের পূর্বে আর্যসমাজে বর্ণপ্রথা প্রচলিত ছিল না। আর্যরা ভারতে আসার পর ঋগবৈদিক যুগে আর্যসমাজে বর্ণপ্রথার প্রচলন ঘটে।

(২) সামাজিক ক্ষেত্র

প্রাচীন ভারতে বর্ণপ্রথা মূলত আর্যদের সমাজেই প্রচলিত হয়েছিল। আর্যসমাজের বাইরে অবস্থানকারী জনসমাজে এই প্রথার প্রচলন ছিল না।

(৩) ভিত্তি

বৈদিক বর্ণপ্রথা মূলত বৃত্তি বা কাজের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। যাগযজ্ঞ পূজার্চনার পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ ব্রাহ্মণ, দেশশাসক ও যােদ্ধারা ক্ষত্রিয়, ব্যাবসায়ীরা বৈশ্য এবং উপরিউক্ত তিন বর্ণকে সেবাদানকারীরা শূদ্র বলে পরিচিত হত। ধীরে ধীরে বর্ণব্যবস্থা একটি শ্রেণিবাচক ধারণায় পরিণত হয়।

(৪) জাতিব্যবস্থার ভিত্তি

প্রাচীনকালে ঋগবৈদিক যুগের‌ বর্ণপ্রথা থেকে পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজে জাতিব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।

বর্ণ ও জাতির পার্থক্য

অনেক সময় আমরা সাধারণভাবে বর্ণ ও জাতি শব্দ দুটিকে অভিন্ন অর্থে প্রয়োগ করলেও বর্ণ ও জাতি দুটি পৃথক সত্তা। তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্ণ ও জাতির মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য লক্ষ্যণীয়।যেমন –

(১) উদ্ভবগত ক্ষেত্রে পার্থক্য

বৈদিক যুগের প্রথমদিকে ৪টি বর্ণকে কেন্দ্র করে মাত্র ৪টি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়, তখনও পর্যন্ত জাতির উদ্ভব হয়নি। পরবর্তী বৈদিক সমাজে নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হলে পুরোনো বর্ণভিত্তিক জনগোষ্ঠীগুলি থেকেই নতুন জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়।

(২) সংখ্যা ও ধারণাগত ক্ষেত্রেপার্থক্য

বৈদিক সমাজের মতো পরবর্তী বৈদিক সমাজে বর্ণ ছিল সংখ্যায় মাত্র ৪টি।শুরুতে পেশা বা বৃত্তির উপর ভিত্তি করে বর্ণব্যবস্থা চালু হলেও পরে এই বিষয়টি মুখ্য থাকেনি।পরবর্তীকালে এটি একটি শ্রেণিবাচক ধারণায় পরিণত হয়।পরবর্তী বৈদিক সমাজে বহু জাতি ছিল। প্রতিটি বর্ণের মধ্যেই অসংখ্য জাতির অস্তিত্ব ছিল। জাতি হল একটি বৃত্তি বা পেশাবাচক ধারণা। বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশার জনগোষ্ঠী নিয়ে জাতি গড়ে ওঠে।

(৩) অস্পৃশ্যতার ক্ষেত্রে পার্থক্য

বর্ণপ্রথায় অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল না। বর্ণগুলি ছিল মুক্ত ও উদার। যোগ্যতা অনুসারে কেউ একবর্ণ থেকে অন্য বর্ণে উন্নীত হতে পারত। কিন্তু জাতিব্যবস্থায় অস্পৃশ্যতার অস্তিত্ব ছিল। জাতিভেদ ভিত্তিক সমাজ ছিল স্থবির।

(৪) গঠন উপাদান এবং শ্রেণিবিন্যাস ক্ষেত্রে পার্থক্য

বর্ণের মূল গঠনশক্তি হল ধর্ম, বংশানুক্রমিকতা এখানে গৌণ। মোটামুটি একই মর্যাদাসম্পন্ন বিভিন্ন জাতি একই বর্ণের অন্তর্ভুক্ত হয়।কিন্তু প্রথম পর্যায়ে জাতির মূল গঠনশক্তি ধর্ম হলেও কালক্রমে এই গঠনশক্তি প্রধানত বংশানুক্রমিক হয়ে পড়ে। বর্ণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো একটি জাতির সামাজিক অবস্থানের পার্থক্য থাকতে পারে।

(৫) অস্তিত্বের বাস্তবতার ক্ষেত্রে পার্থক্য

হিন্দুসমাজে বর্ণ হল একটি ধারণাগত কাঠামো মাত্র। এর বস্তবতা নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।কিন্তু জাতি হল হিন্দু সমাজের বাস্তব অবস্থার পরিচয়।

(৬) বর্তমান সামাজিক গুরুত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য

ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় প্রাত্যহিক কার্যাবলি, রীতিনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বর্ণব্যবস্থার গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম।অন্যদিকে ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় প্রাত্যহিক কার্যাবলি রীতিনীতিতে জাতিব্যবস্থার গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে বেশি।

(৭) সমাজতত্ত্বের গবেষণায় গুরুত্বের ক্ষেত্রে পার্থক্য

ভারতের সামাজিক স্তরবিন্যাস বা গবেষণামূলক কাজের ক্ষেত্রে বর্ণব্যবস্থার গুরুত্ব জাতিব্যবস্থার গুরুত্বের থেকে তুলনামূলকভাবে কম।

Leave a Comment