বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

দশম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়-সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা হতে বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আলোচনা করা হল।

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

প্রশ্ন:- বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহ আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। বিদ্যাসাগর কতটা সাফল্য অর্জন করেছিলেন?

ভূমিকা :- সমাজ সংস্কারকরূপে যে সকল মনীষী ভারতবাসীর মনের মণিকোঠায় চিরশ্রদ্ধার আসন লাভ করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাদের মধ্যে অন্যতম। তারই অক্লান্ত প্রয়াসে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসি বিধবাবিবাহ আইন পাস করেন। তিনি নিজেই বলেছেন বিধবাবিবাহ প্রবর্তন আমার জীবনের সর্বপ্রধান সৎকর্ম।

বিধবাদের অবস্থা

ভারতে হিন্দু সমাজে যে সমস্ত কুপ্রথাগুলি প্রচলিত ছিল বাল্যবিবাহ তার মধ্যে অন্যতম। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হল বাল্যবিধবা। প্রাচীন কালে বিধবা বিবাহের প্রচলন থাকলেও পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধানে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ হয়।

গ্ৰন্থ প্রকাশের মাধ্যমে জনমত গঠন

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিধবাবিবাহের সমর্থনে জনমত গঠন করতে থাকেন। তিনি “বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। পরাশর সংহিতার উদ্ধৃতি থেকে  তিনি প্রমাণ করেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত।

সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত গঠন

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সর্বশুভকরী পত্রিকায় তিনি বাল্যবিবাহের দোষ নামক একটি নিবন্ধ লেখেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন।

সরকারের কাছে আবেদন

সমাজে বিধবাবিবাহকে আইনসিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর গণস্বাক্ষর গ্রহণ করে একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে জমা দেন।

আইন পাস

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও আন্দোলনে ব্রিটিশ সরকার প্রভাবিত হন। অবশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ আইন পাস করে সরকার বিধবাবিবাহকে আইনি স্বীকৃতি দেয়।

বিধবাবিবাহের প্রচলন

১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন বর্ধমানের জনৈক বিধবা কালীমতীকে বিবাহ করলে কলকাতায় প্রথম বিধবাবিবাহ সম্পন্ন হয়। ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর নিজ পুত্র নারায়ণচন্দ্রকে ভবসুন্দরী নামে এক বিধবার সঙ্গে বিবাহ দেন।

বিরোধীদের জবাব

যারা বিধবাবিবাহের বিপক্ষে ছিল কিংবা বিধবাবিবাহের বিরোধিতা করেছিল তাদের উত্তর দেবার জন্য তিনি ‘অতি অল্প হইল’ ও ‘আবার অতি অল্প হইল’ নামে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন।

বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে বিধবাবিবাহের সাফল্য

বিদ্যাসাগর তাঁর বিধবাবিবাহ আন্দোলনে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেন।

নারীমুক্তি

বিধবাবিবাহ আন্দোলনের ফলে বিধবা নারীরা মুক্তির স্বপ্ন দেখার সুযোগ পায়। এরপর বিধবাবিবাহ সংঘটিত হতে থাকলে বিধবাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।

বিধবাবিবাহের প্রসার

বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বোম্বাইয়ের প্রার্থনাসমাজ, মহারাষ্ট্রে ডি কে কার্ভে, মাদ্রাজে বীরসালিঙ্গম পান্তুলু বিধবাবিবাহকে সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন।

সুদূরপ্রসারী প্রভাব

রক্ষণশীলদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বিদ্যাসাগরের শুরু করা বিধবাবিবাহ পরবর্তীকালে স্বাভাবিক নিয়মেই সমাজে নিজের স্থান করে নিয়েছে।

উপসংহার :- বিধবাবিবাহ আন্দোলন ও তার প্রবর্তন ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে হিন্দু বিধবা নারীরা নতুন দিশার সন্ধান পায়।

Leave a Comment