উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

দশম শ্রেণীর ইতিহাস দ্বিতীয় অধ্যায়-সংস্কার: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা হতে উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করা হল।

উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা

প্রশ্ন:- উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতে সমাজ ও ধর্মসংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো। অথবা, ঊনবিংশ শতাব্দীতে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণে রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা করো।

ভূমিকা :- রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩ খ্রি.) ছিলেন উনিশ শতকে বাংলা তথা ভারতের একজন অনন্য প্রতিভাধর মনীষী। তাকে ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত’ বলা হয়। তিনিই প্রথম তাঁর যুক্তিবাদী মন ও অসীম জ্ঞানের আলোতে সমকালীন ভারতীয় সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও দোষত্রুটি গুলি দূর করার চেষ্টা করেন।

ধর্মসংস্কার

রামমোহন হিন্দুসমাজে প্রচলিত পৌত্তলিকতা, বহু দেবতার পূজা, ব্রাহ্মণবাদ, পুরোহিততন্ত্র, অর্থহীন ধর্মীয় রীতিনীতি প্রভৃতি কুপ্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। এক্ষেত্রে তিনি নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। –

(১) একেশ্বরবাদের প্রচার

তিনি প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র থেকে প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। একেশ্বরবাদী নিরাকার ব্রহ্মার আরাধনাই হিন্দুধর্মের মূল কথা। তিনি একেশ্বরবাদের সমর্থনে তুহাফত-উল-মুয়াহিদ্দিন’ নামে ফারসি ভাষায় একটি পুস্তিকা রচনা করেন এবং পাঁচটি প্রধান উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন।

(২) আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা

হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার উদ্দেশ্যে তিনি কলকাতায় তাঁর বন্ধু ও অনুগামীদের নিয়ে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে আত্মীয় সভা প্রতিষ্ঠা করেন।

(৩) ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা

একেশ্বরবাদের প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে এর নাম হয় ব্রাহ্মসমাজ।

সমাজ সংস্কার

রাজা রামমোহন রায় উপলব্ধি করেন যে, প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন না করলে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন কুপ্রথার বিরুদ্ধে তিনি উদ্যোগ গ্ৰহণ করেন। যেমন –

(১) সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা

মানবদরদি রামমোহন তৎকালীন হিন্দু সমাজে প্রচলিত সতীদাহ প্রথা মেনে নিতে পারেননি। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –

(ক) সংবাদপত্রে প্রতিবাদ

অমানবিক এই প্রথার বিরোধিতা করে রামমোহন সংবাদপত্রের মাধ্যমে তার মতামত প্রকাশ করেন। সংবাদ কৌমুদী পত্রিকায় এই প্রথা সম্পর্কে তার মতামত রাখেন।

(খ) গ্ৰন্থ রচনা

সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করে রামমোহন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ‘সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক নিবর্তক সংবাদ’ গ্রন্থটি বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য।

(গ) জনসমর্থন

হিন্দু শাস্ত্র ও বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে তিনি প্রমাণ করেন সতীদাহ ধর্মবিরুদ্ধ ও অশাস্ত্রীয়। এই প্রথা সম্পর্কে তিনি জনসমর্থন আদায় করে বিশিষ্ট নাগরিকদের এক স্বাক্ষর পত্র লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে জমা দেন।

প্রথার নিষিদ্ধকরণ

রামমোহনের অবদানে সাড়া দিয়ে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে এক আইনের মাধ্যমে সতীদাহ প্রথা বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য বলে এই প্রথা নিষিদ্ধ করেন।

(২) জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা

রামমোহন হিন্দু সমাজে জাতি ভেদ ও অস্পৃশ্যতা প্রথার প্রবল বিরোধিতা করেন। এই প্রথার বিরুদ্ধে ‘বজ্রসূচী’ গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করে প্রমাণ করেন জাতিভেদ শাস্ত্র সম্মত নয়।

(৩) নারী কল্যাণ

মধ্যযুগীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীসমাজ ছিল অবহেলিত। দরদী রামমোহন তাই নারী কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। তিনি প্রমাণ করেন পিতা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার আছে। স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে তিনি তার মতামত প্রকাশ করেন এবং উদ্যোগ নেন। বয়সে ছোট কন্যাদের বিবাহের বিরোধিতা করেন।

(৪) বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের বিরোধিতা

বাল্যবিবাহ ও পুরুষের বহুবিবাহ ছিল নারীর কাছে এক অভিশাপ স্বরূপ। সমাজ সংস্কারক রামমোহন এই সমস্যার বিরোধিতা করে জনমত গঠনের চেষ্টা করেন।

(৫) অন্যান্য সামাজিক সংস্কার

সমাজে প্রচলিত আরো একাধিক প্রথার বিরুদ্ধে রামমোহন প্রতিবাদী হয়েছিল। যেমন – কন্যা পন, গঙ্গাসাগরে সন্তান বিসর্জন, কৌলিন্য প্রথা প্রভৃতির বিরোধিতা। এছাড়া তিনি অসবর্ণ বিবাহ সমর্থন করেন।

শিক্ষাসংস্কার

রামমোহন উপলব্ধি করেছিলেন যে, আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষা গ্রহণ না করলে ভারতীয়দের প্রকৃত উন্নতি সম্ভব নয়। শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে রামমোহন রায় যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা হল –

(১) ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা

ভারতের পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। তিনি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড আমহার্স্টকে লেখা এক পত্রে ভারতীয়দের ইংরেজি, পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শন শিক্ষাদানের জন্য সরকারি অর্থব্যয়ের দাবি জানান। কারণ, তার ধারণা ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের মাধ্যমে ভারতবাসী অজ্ঞতা ও জড়তার মধ্যে থেকে মুক্ত হতে পারে।

(২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন

ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় তিনি বহু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজে কলকাতায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পিছনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে বেদান্ত কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি আলেকজান্ডার ডাফকে সহযোগিতা করেন।

(৩) গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকা প্রকাশ

বাংলা ভাষায় রচিত গৌড়ীয় ব্যাকরণ, বেদান্ত গ্রন্থ সহ প্রায় ২৩ টি  গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সংবাদ কৌমুদী ও মিরাৎ- উল -আখবর নামে পত্রিকা। এছাড়া তিনি সংবাদপত্র দমন আইনের বিরুদ্ধে ও বিরোধিতা করেন।

অন্যান্য সংস্কার

রামমোহন ভারতীয় রাজনৈতিক আন্দোলন ও ভারতীয় সাংবাদিকতার অগ্রদূত ছিলেন। তিনি বিচারব্যবস্থার দুর্নীতি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, প্রশাসনে ভারতীয়দের নিয়োগে বঞ্চনা প্রভৃতির প্রতিবাদ করেন। কৃষকদের দুর্দশা মোচনেও তিনি চিন্তা করতেন। তিনি বাংলা ভাষায় ‘সম্বাদ কৌমুদী’ এবং ফারসি ভাষায় ‘মিরাৎ-উল-আখবর’ নামে সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের জনক। ‘বেদান্ত গ্রন্থ’ ও ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।

উপসংহার :- রাজা রামমোহন রায় তার সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের গতিহীন সমাজ জীবনে বিপ্লব এনেছিলেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  তাকে ‘ভারত পথিক’ বলেছিলেন। অধ্যাপক দিলীপ কুমার বিশ্বাস আরও একধাপ এগিয়ে তাঁকে ‘বিশ্বপথিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিশোরীচাঁদ মিত্র, প্যারীচাঁদ মিত্র, বীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধি সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর প্রতি বিনয় শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছেন, “তোমার উপাধি রাজা।

Leave a Comment